দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী (২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪০ – ১৪ আগস্ট ২০২৩) ছিলেন একজন বাংলাদেশী ইসলামি পণ্ডিত, বক্তা এবং রাজনীতিবিদ ও প্রাক্তন সংসদ সদস্য। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে রাজাকার বাহিনীর সদস্য হিসাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত থেকে হত্যার মতো মানবতাবিরোধী কার্যক্রমে সাহায্য করার অভিযোগে তাকে ২০১৩ সালে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।[১][২][৩][৪][৫][৬] তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে-আমীর ছিলেন। তিনি ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রথমবার এবং ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
২০১১ সালে সাঈদীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ দায়ের করা হয়। তার বিরূদ্ধে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুটতরাজের অপরাধের ২০ দফা অভিযোগ আনা হয়।[৭] আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০১৩ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি ২০টি অভিযোগের মধ্যে প্রদত্ত বিচারের রায়ে আটটি অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং দু'টি অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে।[৬][৮][৯][১০][১১][১২] বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক এই রায়ের নিন্দা করে এবং অভিযোগগুলোকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ভুল পরিচয়ের মামলা বলে আখ্যায়িত করে।[১৩][১৪][১৫][১৬] হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তার বিচারের রায়ের সমালোচনা করেছিল।[১৭][১৮] তার ফাঁসির রায় ঘোষণা হওয়ার পর জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গসংগঠনগুলো দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রতিবাদ ও সহিংসতা শুরু করেছিল।[১৯][২০][২১][২২] এই রায়ের পর রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামি পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করা হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিলের রায় পর্যবেক্ষণ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির সাজা কমিয়ে সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড প্রদান করে।[২৩]
দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪০ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পিরোজপুরের ইন্দুরকানীর বালিপাড়া ইউনিয়নের সাঈদখালি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।[২৪] তার পিতার ইউসুফ শিকদার ও মাতার নাম গুলনাহার বেগম। তার পিতা গ্রামের আলেম ও গৃহস্থ ছিলেন।[২৫] তিনি তার বাবার প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় তার প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করেন।[২৫][২৬]
তিনি ১৯৬২ সালে ছারছিনা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন ও পরবর্তীতে খুলনা আলিয়া মাদ্রাসায় স্থানান্তরিত হন।[২৫] ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের পর সাঈদী স্থানীয় গ্রামে ব্যবসা শুরু করেন। তিনি মুসলমান আলেম বা মওলানা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ৩০ বছর। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিচারে তাকে ১৯৭১ সালে পিরোজপুরে মানবাতাবিরোধী কর্মকাণ্ড ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করার অভিযোগে অভিযুক্ত করে।[২৭] তার পুত্র মাসঊদ সাঈদীর মতে তিনি ১৯৭১ সালে পিরোজপুরে ছিলেন না এবং ১৯৬৯ সাল থেকে তিনি যশোরে বসবাস করছিলেন।[২৫]
সাঈদী বাংলা, উর্দু, আরবি ও পাঞ্জাবি ভাষায় দক্ষ ছিলেন এবং ইংরেজি ও ফরাসি ভাষাও তার আয়ত্ত্ব করেছিলেন।[২৫]
দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন ১৯৭৯ সালে। তিনি ১৯৮২ সালে জামায়াতের রুকন ও ১৯৮৯ সালে মজলিশে শূরা সদস্য হন। ১৯৯৬ সালে জামায়াতের নির্বাহী পরিষদ সদস্য হন। তিনি ২০০৯ সাল থেকে আমৃত্যু বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।[৩৬]
১৯৮০’র দশকের প্রথমদিকে সাঈদী সারা দেশব্যাপী ইসলামী ওয়াজ-মাহফিল ও তাফসির করা শুরু করেন এবং তার সুন্দর বক্তব্য দানের ক্ষমতার জন্য দেশব্যাপী জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।[৩৭]
১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পিরোজপুর-১ আসন থেকে অংশ নিয়ে তিনি প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও একই আসন থেকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নির্বাচনী জোট গঠন করে এবং তিনি এই নির্বাচনে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।[২৫]
গ্রেফতার
ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুভূতিতে আঘাত করেছে” মর্মে অভিযোগে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ২১ মার্চ তারিখে দায়েরকৃত বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীর মামলার প্রেক্ষিতে ঐ বছর ২৯ জুন তারিখে রাজধানীর শাহীনবাগের বাসা থেকে পুলিশ দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীকে গ্রেপ্তার করে।[৪৪]
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ২০২৩ সালের ১৪ আগস্ট হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৮৩ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।[১০৩] এর আগে ১৩ আগস্ট রবিবার তিনি কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পরে তাকে কারাগার থেকে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নেওয়া হয়।[১০৪] ১৫ আগস্ট ২০২৩ পিরোজপুরের সাঈদী ফাউন্ডেশনে জানাজা নামাজের পর সমাহিত করা হয়।[১০৫]
১ অক্টোবর ২০২৪ সালে তাঁর ছেলে মাসুদ সাঈদী দাবি করেন যে, কারাগার থেকে সুস্থ সাঈদীকে এনে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছিলো হাসিনা সরকার। [১০৬]