* আধুনিক ইতিহাসচর্চার বৈচিত্র্য ও আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার উপাদান ব্যবহারের পদ্ধতি
গ্রীক শব্দ হিস্টোরিয়া (Historia) থেকে ইতিহাস শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। ইতিহাস হল অতীতের কাহিনী বা বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ। ইতিহাসেই প্রতিফলিত হয়েছে মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, সাংস্কৃতিক বিবর্তন এবং রাজনৈতিক সত্তা।
• গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাসকে ইতিহাসের জনক বলা হয়। তাঁর লেখা 'হিস্টোরিয়া' গ্রন্থটি একটি ইতিহাসমূলক গ্রন্থ। হিস্টোরিয়া শব্দের অর্থ হল অনুসন্ধান। ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের মতে, 'ইতিহাস হল দর্শনের একটি শাখা'।
* জেনে রাখবে: বৈজ্ঞানিক ইতিহাসের জনক হলেন থুকিডিডিস।
• ইতিহাস পাঠের প্রকৃত উদ্দেশ্য হল- অতীতের অভিজ্ঞতা নিয়ে বর্তমান চলার পথ তৈরি করা এবং সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা। * জেনে রাখবে: কিউরির মতে, 'ইতিহাস হল বিজ্ঞান, কমও নয়, বেশিও নয়।
• উনবিংশ ও বিংশ শতকে ভারতীয় ইতিহাসের ধারণার ক্ষেত্রে নানা পরিবর্তন ঘটেছে। এই ধারণার বেশিরভাগই হল ঔপনিবেশিক কাজকর্ম এবং তার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের ঐতিহ্য।
* পূর্বে ইতিহাস কেবলমাত্র রাজনৈতিক ইতিহাসের মধ্যে (রাজা-রানী ও সাম্রাজ্যের উত্থান পতন) সীমাবদ্ধ থাকত। বর্তমানে ইতিহাসের পরিধি অনেক বেশি সম্প্রসারিত হয়েছে মানুষের জীবনযাত্রা, খেলাধুলা, খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি, পোশাক-পরিচ্ছদ, যানবাহন, পরিবেশ- সবই ইতিহাসচর্চার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাই ঐতিহাসিক জি.এম. ট্রেভেলিয়ান ইতিহাস বিদ্যাকে অন্যান্য বিদ্যাচর্চার জননী বলেছেন।
* জেনে রাখবে: নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার জনক ছিলেন রণজিৎ গুহ । (২৩ মে, ১৯২৩ ২৮ এপ্রিল, ২০২৩) তাঁর লেখা প্রথম গ্রন্থটির নাম 'সাবল্টার্ন স্টাডিজ'।
* 'সাবল্টার্ন' শব্দ প্রথম ব্যবহার করে অ্যান্টনিও গ্রামশি।
আধুনিক ইতিহাস চর্চার বৈচিত্র্য --ইতিহাস চর্চার বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সমস্ত ঐতিহাসিকরা যুক্ত আছেন তারা হলেন (i) জাতীয়তাবাদী ইতিহাস চর্চা- যদুনাথ সরকার, রমেশ চন্দ্র মজুমদার, তারাচাঁদ প্রমূখ। (ii) সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাস চর্চা- রুডিয়ার্ড কিপলিং, জেমস মিল, উইলিয়াম হান্টার, ভিনসেন্ট স্মিথ প্রমুখ। (iii) কেমব্রিজ গোষ্ঠীর ইতিহাস চর্চা-গর্ডন জনসন, অনিল শীল, জন গ্যালাহার, ফ্রান্সিস রবিনসন প্রমুখ। (iv) মার্কসবাদী ইতিহাস চর্চা- বিপানচন্দ্র, সুমিত সরকার, রজনীপাম দত্ত প্রমূখ। (v) অ্যানাল ইতিহাস চর্চা- মার্ক ব্লখ, জর্জ ব্রদেল, লাদুড়ি প্রমুখ। (vi) নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চা- রণজিৎ গুহ, গৌতম ভদ্র, শাহিদ আমিন প্রমুখ।
• মনে রাখতে হবে: ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে রঞ্জিত গুহ তাঁর গ্রন্থে (On some Aspects of the Historiography of Colonial India) ভারতবর্ষে নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চা শুরু করেন।
* ইতিহাস সম্পর্কে বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের ধারণা:
মার্ক ব্লখ-এর মতে, 'History is the Science of men in time' |
ই.এইচ.কার-এর মতে, 'ইতিহাস হল অতীত ও বর্তমানের মধ্যে অন্তহীন কথোপকথন'।
হেনরি পিরেন-এর মতে, 'আমি ঐতিহাসিক, ইতিহাসে জীবনের সন্ধান করি, জীবনকে ভালোবাসি'।
নতুন সামাজিক ইতিহাস:
নতুন সামাজিক ইতিহাস-এর সংজ্ঞা ইতিহাস হল মানব সভ্যতার ক্রম বিবর্তনের ধারাবাহিক বিবরণ। অতীত ইতিহাসে শুধুমাত্র রাজা-মহারাজা কিংবা অভিজাতদের কথা লেখা থাকত। কিন্তু ১৯৬০-৭০ এর দশকে এই ধারায় পরিবর্তন এসেছে। এখানে সাধারণ মানুষ, নিম্নবর্গীয় সমাজ, এমনকি প্রান্তিক অন্ত্যজদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় জীবনের বিবর্তনের কথাও সমানভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। আধুনিক ইতিহাস চর্চার এই ধারা নতুন সামাজিক ইতিহাস নামে পরিচিত। বাংলার নমঃশূদ্র আন্দোলন সামাজিক ইতিহাস চর্চার অন্তর্গত।
এরিক হবসবম, এডওয়ার্ড থমসন, এরিক ইভান্স প্রমুখ ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের হাত ধরে জন্ম নেয় নতুন সামাজিক ইতিহাস। এই সময় থেকে বিভিন্ন ঐতিহাসিক নতুন সামাজিক ইতিহাসকে জনপ্রিয় করে তোলেন। যেমন-অ্যানাল গোষ্ঠী। ফ্রান্সের অ্যানাল স্কুল মতবাদের ঐতিহাসিকরা ছিলেন এই ধারার ইতিহাস চর্চার পথপ্রদর্শক। মার্ক গ্রন্থ এবং লুসিয়েন ফেবর ফ্রান্সে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে বা অ্যানাল' পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে তাদের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে অ্যানাল স্কুল। ফ্রান্সে নতুন সামাজিক ইতিহাসের চর্চা 'অ্যানালস স্কুল' নামে পরিচিত ছিল। আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা এবং ভারতে এই লারার ব্যাপকভাবে চর্চা শুরু হয়। *
জেনে রাখবে: অ্যানালস পত্রিকায় নিম্নবর্ণীয় জনগোষ্ঠীর ইতিহাস তুলে ধরা হত। (পর্ষদ নমুনা প্রশ্ন) • নতুন সামাজিক ইতিহাসের প্রধান বৈশিষ্টা হল নিম্নবর্গের ইতিহাস পর্যালোচনা।
* সাব-অলটার্ন গোষ্ঠী: ১৯৮০-র দশকে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নিম্নবর্গের প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে যে ইতিহাস চর্চা শুরু হয় তাকে বলা হয় নিম্নবর্গীয় ইতিহাস। নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চা ভারতে শুরু হয়েছিল ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে অধ্যাপক রণজিৎ গুহ রচিত সাবল্টার্ন স্টাডিজের প্রথম খন্ড প্রকাশের দ্বারা। অতঃপর পার্থ চট্টোপাধ্যায়, গৌতম ভদ্র, সুদীপ্ত কবিরাজ, জ্ঞানেন্দ্র পান্ডে, দ্বীপেশ চক্রবর্তী প্রমুখ এই ইতিহাস চর্চাকে সাফল্যের সাথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। * নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার জনক বলা হয় ড. রনজিৎ গুহ কে।
নতুন সামাজিক ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য:
(i) নতুন সামাজিক ইতিহাসে রাজা-মহারাজা বা অভিজাত বর্গের আলোচনার পাশাপাশি সাধারণ মানুষ, নিম্নবর্গের মানুষ, এমনকি প্রান্তিক অন্তজদের জীবনযাত্রা সমানভাবে আলোচিত হয়। * নতুন সামাজিক ইতিহাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল নিম্নবর্গের ইতিহাস পর্যালোচনা। (পর্ষদ নমুনা প্রশ্ন) (ii) নতুন সামাজিক ইতিহাসের পরিধি ব্যাপক। খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, শিল্পচর্চা, খেলাধুলা, পরিবেশ, নারীবাদ, জাতীয়তাবাদ এইসব বিভিন্ন সামাজিক বিষয় এই ইতিহাস চর্চার অন্তর্ভুক্ত। (iii) ১৯৮০-র দশক থেকে ভারত-সহ দক্ষিণ এশিয়ার সাব-অলটান বা নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার মধ্যে দিয়ে নতুন সামাজিক ইতিহাস চর্চা শুরু হয়েছে। (iv) এই পর্বের ইতিহাস চর্চায় আঞ্চলিক ইতিহাসকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।