কমলাকান্তের জন্মস্থান বর্ধমান জেলার গঙ্গাতীরস্থ অম্বিকা কালনা। মাতার নামা মহামায়া, পিতার নাম মহেশ্বর। দশ বছর বয়সে তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়। বালক কমলাকান্ত সুগায়ক ছিলেন এবং রামপ্রসাদের গানে বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি মাঠে ঘাটে আপনমনে গান গেয়ে বেড়াতেন। শোনা যায়, একদিন রাত্রে গঙ্গাতীরের শ্মশানের অন্ধকারে আত্মমগ্ন হয়ে গান গাইবার সময় এক অশরীরী তান্ত্রিক কাপালিক তাঁকে কালীনামে দীক্ষা দিয়ে যান এবং সেই মন্ত্র জপ করতে করতে সেখানেই আনন্দময়ী নৃত্যরতা ‘স্মেরাননী’ (স্মিত-আননা) শ্যামা মায়ের দর্শন পান। এই ঘটনার পর থেকে তিনি চান্না গ্রামে মাতুলালয়ে থেকে বিদ্যা ও সংগীতচর্চা করতে থাকেন। এখানেই তাঁর বিবাহ হয়, তবে বিবাহজীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি—অল্প কিছু সময়ের মধ্যে পর পর তাঁর মাতৃবিয়োগ ও পত্নীবিয়োগ ঘটে। শোনা যায়, চিতাগ্নির মধ্যে জগদম্বার আবির্ভাব দেখে তিনি চিতার চারপাশে নৃত্য করতে করতে গেয়েছিলেন তাঁর সদ্যরচিত গান—
কালী! সব ঘুচালি লেঠা,
তোমার যারে কৃপা হয়, তার সৃষ্টিছাড়া রূপের ছটা
তার কটিতে কৌপিন জোটে না, গায়ে ছাই আর মাথায় জটা
শ্মশান পেলে সুখে ভাসে, তুচ্ছ ভাবে মণিকোঠা।
চান্নার বিশালাক্ষী মন্দিরে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন কমলাকান্ত এবং আচার্যপদে বৃত হন।
কমলাকান্তের কালীভক্তির কথা অচিরেই ছড়িয়ে পড়ে এবং তাঁর রচিত শ্যামাসংগীত জনসমাদর লাভ করে। বর্ধমানরাজ তেজচাঁদ মহতাব সংগীতপ্রেমী ছিলেন। ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর কালনার রাজপ্রাসাদের সভাগৃহে আয়োজিত এক সাংগীতিক জলসায় কমলাকান্ত সংগীত পরিবেশন করেছিলেন, যেগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ‘আদর করে হৃদে রাখো আদরিণী শ্যামা মাকে’, যা পরবর্তী পাঠান্তরে হয়েছে ‘যতনে হৃদয়ে রেখো আদরিণী শ্যামা মাকে’। এর অনতিকাল পরেই রাজা তেজচাঁদ কমলাকান্তকে বর্ধমান শহরে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন এবং বর্ধমান রাজবাড়ির সন্নিকটে কোটালহাটে তাঁর জন্য এক কালীমন্দির নির্মাণ করিয়ে দেন। এভাবেই কমলাকান্ত বর্ধমান নগরীর স্থায়ী বাসিন্দা হন, এবং আনুমানিক ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে সেখানেই তাঁর মৃত্যু ঘটে।
তেজচাঁদের পুত্র প্রতাপচাঁদ মহতাব ছিলেন কমলাকান্তের সাধনপথের অনুগামী। তিনি নিজেও বেশ কয়েকটি শ্যামাসংগীত রচনা করেছিলেন। পরবর্তী বর্ধমানরাজ মহতাবচাঁদের (রাজ্যকাল ১৮৩২–১৮৭৯) উদ্যোগে কমলাকান্ত-রচিত গীতিসমূহের সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে। প্রথম প্রকাশনায় শিব, কৃষ্ণ, চৈতন্য সম্পর্কিত ২৪টি, উমা সম্পর্কিত ৩২টি এবং শ্যামাসংগীত ২১৩টি—সর্বসাকুল্যে ২৬৯টি কাব্যগীতি মুদ্রিত হয়েছিল। কথামৃতের সুবাদে জানতে পারা যায় রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব কমলাকান্তের কয়েকটি শ্যামাসংগীতের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন এবং গাইতেন। কমলাকান্তের গীতিসংগ্রহের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৮৫ সালে। সেইটির এক কপি সংগ্রহ করে শ্রীরামকৃষ্ণভক্তেরা ডা: মহেন্দ্রলাল সরকারকে উপহার দেন। শ্রীরামকৃষ্ণের গাওয়া গানগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘মজল আমার মনভ্রমরা শ্যামাপদ হৃৎকমলে’, ‘শ্যামা মা কি আমার কালো রে’, ‘যতনে হৃদয়ে রেখো আদরিণী শ্যামা মাকে’, ‘শ্যামাধন কি সবাই পায়’ এবং ‘সদানন্দময়ী কালী মহাকালের মনমোহিনী’।
আধ্যাত্মিক সাধকের কাছে সংগীত ভগবৎ-সাধনারই এক অঙ্গ। আউল-বাউল, মীরারাই, নানক, কবীর, তুকারাম সকলেই গানের অর্ঘ্য সাজিয়েছেন তাঁদের উপাস্যের উদ্দেশ্যে। সেই ধারা প্রবাহিত হয়েছে রামপ্রসাদ আর কমলাকান্তের গানে, এবং অনেক পরিশীলিত রূপে রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের গানে। কমলাকান্ত রামপ্রসাদের উত্তরসূরী, বাল্যকাল থেকেই তাঁর ভক্তিগীতিতে প্রভাবিত। তাই তাঁর কিছু গান, কিঞ্চিদধিক দশ শতাংশ, প্রসাদী সুরে আধারিত। তবে প্রথাগতভাবে রাগসংগীত শিক্ষার কারণে কমলাকান্তের অধিকাংশ গানই রাগাশ্রয়ী এবং যথাযথ তালনিবদ্ধ। রামপ্রসাদের গানের সঙ্গে তাঁর গানগুলির আর একটা পার্থক্য আছে যা অধ্যাপক জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তীর উদ্ধৃতিতে—‘রামপ্রসাদের শ্যামাসংগীত সুরে সমর্পিত হইবার অপেক্ষা রাখে, গানে না শুনিলে তাহার অর্ধেক মাধুর্য নষ্ট হইয়া যায়। কিন্তু কমলাকান্তের পদাবলি গীতিকবিতার মতন আস্বাদ্য, কেবলমাত্র আবৃত্তি করিয়াও তাহার মাধুর্য আস্বাদন করা সম্ভব।’
#biography
#sadhakkamalakanta
#devotional
#kalipuja2023
#maakali
#সাধককমলাকান্ত
#bangla
#information
#jiboni